কংক্রীটে বন্দিদশায় হাঁপিয়ে ওঠা মানুষগুলোর যখন ঘুম ভাঙ্গতো পাখির কিচির মিচির শব্দে, কিংবা গ্রামের মানুষগুলো অলস সময়ের যাঁতাকলে হাসপাস্ করছিলো খাঁচা ভেঙ্গে উড়াল দেয়া পাখির মতো উড়াল দেববে বলে । তখনি বার্তা এলো অবমুক্ত হবে পথ,অফিস আদালত,দোকান-পাঠ। বেঁধে দেয়া হলো সুপরিকল্পিত কিছু নীতিমালাও। মানুষ কি এখন মুক্ত বিহঙ্গের মতো ,,,,,! তবে কেমন ছিলো ৬২ দিনের গৃহবন্দী জীবন! সত্যিই কি আমরা বন্দি ছিলাম? যেমন বন্দি থাকে চুরি-ডাকাতি, গুম, খুন,সন্ত্রাসের দায়ী অভিযুক্ত আসামীরা। আমরা এর কোনটাই ছিলাম না।
নিজেকে ভালো আর নিরাপদ রাখতেই ঘরে থাকাটা বাধ্যতামূলক হয়ে পড়েছিলো । টেনশন, উত্তেজনা, উৎকণ্ঠা,ভয় আর বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্য দিয়েই কেটে গেছে প্রায় দুটো মাস। সবচেয়ে কঠিন কষ্টে দিনাতিপাত করেছে মধ্যবিত্তরা। উচ্চবিত্তের আয়েশী জীবন আর নিম্নবিত্তের মৃত্যুক্ষুধা,,,,,,,,
সব মিলিয়ে এক অসম পরিণতির নিগৃহীত রূপ আমরা অবলোকন করেছি এতদিন। ময়মনসিংহের প্রাণকেন্দ্রের ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান মুকুল নিকেতন উচ্চ বিদ্যালয়। অত্র প্রতিষ্ঠানের হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে সবাই প্রায় সচ্ছল জীবন-যাপন করছে, এমনটিই ধারনা আমাদের । লক ডাউন আমাদের ধারণা পাল্টে দিলো। পুরোনো অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রী প্রধান শিক্ষক মহোদয়ের নিকট সাহায্যের আবেদন নিয়ে এসেছে। সপরিবারে না খেয়ে আছে সারাদিন, কেউ দুর থেকেও মেসেজ পাঠিয়েছে মা-বাবা সন্তান নিয়ে উপবাস করছে।
চারটা খেয়ে বাঁচার জন্য উপায়ান্তর না দেখে তারা নিজের প্রতিষ্ঠানে হাত পেতেছে। প্রধান শিক্ষক মহোদয় সবার সাথে কথা বলে এমন অসংখ্য অসহায়কে সাহায্য করেছেন। আমার এক ছাত্র একদিন আমার ইনবক্সে একটি মেয়ের ছবি পাঠালো, এবং তার মেসেজ গুলোও। সামান্য চাল-ডালের জন্য একটা মধ্যবিত্ত ঘরের অসহায় মেয়ের কী গভীর আকুতি ভরা মেসেজ। নিজে টিউশনি করে সংসার চালায়, ঘরে মা আর ছোট বোন। লকডাউনে সব বন্ধ। তারা এখন দু’চোখে অন্ধকার দেখছে। যৌন কর্মীরা আমাদেরি সমাজের অংশ, যদিও আমরা তাদের ঘৃণার চোখে দেখি। অনাহারে অর্ধাহারে কেটেছে এই দিনগুলো তাদের, কতটা খবর রেখেছি আমরা তাদের।
এক সদ্য প্রসূতি মা নিজের, সন্তানের কারোর খাবারের কোন ব্যবস্থা নেই, উপায়ান্তর না দেখে মাত্র দশহাজার টাকার বিনিময়ে নিজের সন্তানকে বিক্রি করে দিতে চেয়েছে। বাচ্চাটার ছবি দেখে ভেতরটা ধুমরে মুচরে উঠলো। এর শেষ কোথায় বলতে পারেন?? এমন হাজারো চিত্র আমাদের চোখের সামনে। ছেলে-মেয়ের স্কুল,কোচিং,প্রাইভেট সব বন্ধ। বাবা-মায়ের কর্ম নেই, খাবারও নেই। এমন সংখ্যাই সমাজে অধিক।
মাত্র দুটো মাসেই জীবনের প্রতি নাভিশ্বাস উঠে গেছে সাধারণ মানুষের। কবে উঠে যাবে লকডাউন,মানুষ ফিরে যাবে তার স্বাভাবিক কাজ-কর্মে। সবার চোখ আটকে থাকতো দুপরের হেলথ বুলেটিনে। শিশু, ছেলে,বুড়ো সবাই এক রকম ভার্চুয়াল ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে পড়েছে। টানা-পোড়েন সংসারে স্বামী-স্ত্রীতে ঝগড়া, অভাবের তাড়নায় বেড়ে গেছে চুরি,ছিনতাই। এই তো কয়েকদিন হবে আমার এক ফেসবুক বন্ধুর পোস্টে দেখলাম তাদের জানলার গ্রীল কেটে এক কিশোর ঘরে প্রবেশ করলো। সব উল্টা-পাল্টা করে যখন কোন টাকা পয়সা পেলো না এমন সময় তার চোখে পড়লো সিসি ক্যামেরা।
ক্যামেরার দিকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে অবশেষে সে নিশব্দে বেরিয়ে গেল। তবে দেশের এই অস্থায় অনেক বিত্তবানেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। আর যারা সামর্থ থাকা সত্যেও এগিয়ে আসেননি তারা প্রতিনিয়তই মানসিক দৈন্যতায় ভোগেন। এরাও ভাইরাসের মতো, এদের কাছ হতে আমাদের দুরে থাকাই নিরাপদ।
সীমিত পরিসরে খুলে দেয়া হয়েছে যান বাহন। ভাড়া বেড়েছে ৬০%। অন্যদিকে বিমানের ভাড়া এক টাকাও বাড়েনি। সাধারণ যানে সীমিত যাত্রী বহন করাই নাকি এর উদ্দেশ্য। এদেশে গেইটলক বাস নিশ্চই আপনারা দেখেছেন। একমাত্র এনা বাস ছাড়া গেইটলকে অতিরিক্ত যাত্রী নেই কেউ দেখেছেন, এমন লোক খুঁজে পাওয়া ভার। একদিকে আর্থিক টানা পোড়েন, অন্যদিকে করোনা আতঙ্ক। তবে বাংলাদেশের ক্ষুধা আর দারিদ্রতার আতঙ্ক ইতোমধ্যে করোনা আতঙ্ককেও ছাড়িয়ে গেছে। তাই সরকার আজ বাধ্য হয়েই লকডাউন উঠিয়ে নিয়েছেন।
অনেক অন্যায় আর অনিয়ম আমাদের গা সওয়া হয়ে গেছে। করোনা অত সহজে আমাদের ছেড়ে যাচ্ছে না। গৃহবন্দির দুূর্বিসহ দিন গুলোর সাথে আমরা অধিকাংশই পরিচিত হয়ে উঠেছি। সেই দুর্বিসহ দিনগুলোর কথা মাথায় রেখে কিছু অভ্যাস গা সওয়া করে নিন। নিয়মিত হাত সাবান দিয়ে বারবার ধুয়ে নিন,মাস্ক ব্যবহার করুন।যতটা সম্ভব ভিড় এড়িয়ে চলুন।
সামাজিক দুরত্ব বজায় রেখে চলুন। মনে রাখবেন এনভয় গ্রুপের চেয়ারম্যান, এপেক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি এমনকি মানবতার ফেরিওয়ালা খ্যাত নারায়নগঞ্জের কাউন্সিলর খোরশেদ আলম প্রমুখ আজ করোনায় আক্রান্ত। এরি মধ্যে সাবেক সচিব, অধ্যাপক,ডাক্তার, সাংবাদিক, পুলিশ অফিসার এমন কি শিল্পপতিরা অনেকেই এই ক্ষুদ্র ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন। আমরা যদি এখনো সচেতন না হই তবে এর হাত থেকে কেউই রেহাই পাবো না। লকডাউন উঠে যাওয়াতে আমরা মুক্ত এমনটি ভাবার কোন কারণ নেই। এতে আমাদের বন্দিত্ব শেষ তো হয়েই নি বরং অনেকগুন বেড়ে গেছে। ঘরে আপনি ফ্রী থাকতে পারতেন, এখন আপনাকে প্রতিটি মুহূর্তে সচেতন থাকতে হবে । মনে রাখবেন আপনার অসচেতনতা আপনার পুরো পরিবারকে নিরাপত্তাহীন করে দেবে মুহূর্তেই।
নাহিন শিল্পী
শিক্ষক, সমাজ সেবক।